পেনসিলভেনিয়া, ১৩ জুলাই ২০২৫। বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক এবং কৌতূহলের উৎস হিসেবে পরিচিত আনাবেল পুতুলকে ঘিরে আবারও নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে, যখন এই পুতুলের প্রদর্শনী সফরে অংশ নেওয়া একজন অভিজ্ঞ প্যারানরমাল তদন্তকারী হঠাৎ করে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত ব্যক্তির নাম ড্যান রিভেরা, বয়স ৫৪, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ড সোসাইটি ফর সাইকিক রিসার্চ বা এনইএসপিআরের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য ছিলেন। তিনি এড ও লরেইন ওয়ারেনের ভৌতিক সংগ্রহের অন্যতম পরিচিত উপাদান আনাবেল পুতুল নিয়ে দেশব্যাপী একটি প্যারানরমাল সফরে অংশ নিয়েছিলেন, যার নাম দেওয়া হয়েছিল “ডেভিলস অন দ্য রান”।
এই সফরের অংশ হিসেবে আনাবেল পুতুলটিকে বিভিন্ন শহরে কাচের বাক্সে আবদ্ধ অবস্থায় প্রদর্শন করা হচ্ছিল এবং দর্শকদের সামনে ওয়ারেন দম্পতির ভৌতিক ইতিহাসের নানা ঘটনা বর্ণনা করা হচ্ছিল। সফরের এক পর্যায়ে পেনসিলভেনিয়ার একটি হোটেলে অবস্থান করার সময়, ড্যান রিভেরা নিজের রুমে রাত কাটান এবং পরদিন সকালে কোনো সাড়া না দিলে সহকর্মীরা দরজা খুলে তাকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পান।
ঘটনাস্থলে পৌঁছানো পুলিশ জানায়, রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল এবং ভেতরে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা সংঘর্ষের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। রুমটি ছিল গোছানো এবং দেহের আশেপাশে ছিল না কোনো ধরণের সন্দেহজনক বস্তু। আনাবেল পুতুলটি ওই সময় হোটেলের নির্দিষ্ট স্টোরেজ রুমে কাচের কেসে তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। পুলিশ নিশ্চিত করে যে মৃত্যুর সময় পুতুলটি রিভেরার রুমে ছিল না।
ড্যান রিভেরার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। স্থানীয় করনার অফিস জানিয়েছে, ময়নাতদন্ত চলছে এবং পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট আসতে ৮ থেকে ১০ সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। প্রাথমিকভাবে মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলা হলেও, বিষক্রিয়া, হৃদরোগ অথবা কোনো অজানা কারণ রয়েছে কিনা, তা জানার জন্য বিস্তারিত পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
ড্যান রিভেরার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র আলোচনার জন্ম নেয়। অনেকেই মনে করছেন, এটি নিছক কাকতালীয় মৃত্যু নয়। যদিও আনাবেল পুতুল ঘটনাস্থলে ছিল না, তবু বহু মানুষ বিশ্বাস করছেন যে পুতুলটির অলৌকিক শক্তির কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, বাস্তববাদীরা বলছেন, এটি নিছকই একটি অপ্রত্যাশিত কিন্তু প্রাকৃতিক ঘটনা, এবং এর সঙ্গে কোনো অশরীরী বিষয় জড়িত নয়।
আনাবেল পুতুলটির ইতিহাস ঘিরে এমনিতেই রয়েছে রহস্য ও ভয়। ১৯৭০-এর দশকে এক তরুণ নার্স পুতুলটি উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন এবং কিছুদিন পর থেকেই তার রুমে শুরু হয় নানা অদ্ভুত ঘটনা। পুতুলটি নিজে নিজে স্থান পরিবর্তন করত, কাগজে বার্তা রেখে যেত এবং এক পর্যায়ে শারীরিক আঘাতের ঘটনাও ঘটে। নার্সটি ও তার রুমমেট তখন প্যারানরমাল বিশেষজ্ঞ এড ও লরেইন ওয়ারেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওয়ারেন দম্পতি পুতুলটিকে পরীক্ষা করে জানায়, এটি কোনো শিশু আত্মা নয় বরং একটি ‘দানবীয় সত্তা’ দ্বারা অধিকারভুক্ত। এরপর তারা পুতুলটিকে নিজেদের সংগ্রহে নেন এবং কাচের বাক্সে তালাবদ্ধ করে নিজেরা একটি মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করেন, যাতে এটি আর কারো ক্ষতি করতে না পারে।
ওয়ারেন দম্পতির এই কাহিনী থেকেই জন্ম হয় জনপ্রিয় সিনেমা সিরিজ “The Conjuring Universe”-এর, যার অংশ হিসেবে তৈরি হয় “Annabelle” সিনেমাগুলো। সিনেমায় দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর চোখমুখের পুতুল, তবে বাস্তবের আনাবেল একটি তুলোর তৈরি সাধারণ র্যাগডি অ্যান পুতুল, দেখতে নিরীহ হলেও যাকে ঘিরে রয়েছে বহু ঘটনার দাবি।
NESPR-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ড্যান রিভেরার মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক এবং তারা তার স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে সফর চালিয়ে যাবে। তাদের মতে, রিভেরা ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ গবেষক যিনি মানুষের মধ্যে ভৌতিক গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। তারা অনুরোধ জানিয়েছে, যতক্ষণ না আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট আসে, ততক্ষণ কেউ যেন গুজবে কান না দেয়।
ড্যান রিভেরার পরিবার জানিয়েছে, তিনি ছিলেন একজন মানবিক, সাহসী এবং সত্যের সন্ধানে নিবেদিত মানুষ। তার আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবার শোকাহত হলেও তারা চান না ঘটনাটিকে ঘিরে অহেতুক ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে উঠুক।
এতসব ঘটনার পরও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—আসলে আনাবেল পুতুল কী? অনেকেই বলছেন এটি একটি দানবীয় আত্মা দ্বারা দখলকৃত বস্তু, অন্যদিকে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বলছে, এটি কেবলই এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব এবং কল্পনার ফল। বাস্তবিক অর্থে পুতুলটি এখনো একটি নিরাপদ কাচের বাক্সে সংরক্ষিত রয়েছে এবং তার আশেপাশে এমন কিছু ঘটেনি যা একে অবিশ্বাস্য করে তোলে।
তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, আনাবেল পুতুলকে ঘিরে প্রতিটি মৃত্যু, প্রতিটি অস্বাভাবিক ঘটনা মানুষের মনে আবার প্রশ্ন তোলে—আনাবেল কি শুধুই একটি পুতুল, নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা এখনো বিজ্ঞানের বাইরে?
